![রিজার্ভ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে: বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে: বাংলাদেশ ব্যাংক](https://www.aloavanews24.com/media/imgAll/2023May/rer-2311301734.jpg)
ছবি: ইন্টারনেট
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবুও পতন থামছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতি মাসেই রিজার্ভের পরিমাণ আগের মাসের তুলনায় কমছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য নেই। ফলে প্রতি মাসে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাজারে ডলারের অভাব রয়েছে। সেটা আংশিক পূরণ করার জন্য প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এভাবে চলতে থাকলে রিজার্ভ কমতেই থাকবে। তবে সেটা শূন্যের নিচে নামার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নভেম্বরে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রস্তাবিত বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করে করা হিসাব অনুসারে, রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ আসলে কত?
চলতি বছরের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জানুয়ারিতে মোট রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ নভেম্বরে যা ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ১১ মাসের মধ্যে শুধু জুনেই রিজার্ভের পরিমাণ আগের মাসের তুলনায় কিছুটা বেড়েছিল। বাকি মাসগুলোতে ক্রমান্বয়ে কমেছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
গত জুনে আইএমএফের নির্ধারিত হিসাব পদ্ধতি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল-সিক্সথ এডিশন (সংক্ষেপে বিপিএম৬) অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের গণনা শুরু হয়। ওই মাসে এই পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বরে তা ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এই ৬ মাসে রিজার্ভ প্রায় প্রতিবারই আগের মাসের তুলনায় কমেছে।
বলা হচ্ছে, বিপিএম অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি দেখানো হচ্ছে। সেটি আসলে আরও কমবে। কারণ এর চেয়ে আইএমএফের এসডিআর খাতে, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা এবং আকুর বিল পরিশোধ বাবদ অর্থ বাদ দিলে রিজার্ভ আরও কমে আসবে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে সমস্যা হচ্ছে সরকারের অনেক অপরিশোধিত বিল রয়েছে। যেগুলো এখনও শোধ করা হয়নি। এগুলো পুরোটা পরিশোধ করলে রিজার্ভ হয়তো অনেক কমে যাবে।
তবে এক্ষেত্রে দ্বিমত প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, দুটি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একটা হচ্ছে গ্রস বা মোট। অর্থাৎ যে পরিমাণ বিদেশি সম্পদ হাতে আছে, যা নভেম্বরে ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন। আরেকটা হচ্ছে বিপিএম-৬ অনুযায়ী হিসাব, যা ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন।
তিনি বলেন, এখন আপনি যদি এর চেয়ে আরও কিছু বাদ দিতে চান, তাহলে সেটার বেসিসটা কী? লায়াবিলিটিস (দায়) তো আমার কত লায়াবিলিটি আছে, সেটা কি আমি সব হিসাব করবো? আইএমএফের কাছে যে ডিপোজিটটা আছে সেটা কি আমার টাকা না?
মেজবাউল হক মনে করেন, আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাবের পরও মানুষকে আসলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইএমএফের পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তবু কেন প্রশ্নটা আসছে?
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অবশ্য বলেন, ব্যাংকে যে অর্থ থাকে তা হিসাবধারীর নিজের টাকা হলেও সেটার যে দায় আছে, সেগুলো ব্যবহার করা যায় না। তাই ব্যবহারযোগ্য টাকাটাই আসলে হিসাবধারীর মূল অর্থ বলে বিবেচিত হয়। একই পদ্ধতি রিজার্ভের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
যে কারণে রিজার্ভের ঘাটতি
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রিজার্ভের পরিমাণ গড়ে প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন করে কমার কারণ হচ্ছে ডলারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। পর্যাপ্ত জোগান না থাকার কারণে আমদানি কমালেও তা ধরে রাখতে সহায়ক হয়নি। দেশে ২০২১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কোভিডের পর ডলারের চাহিদা অনেক কমে গিয়েছিল। তবে সেসময় তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি চালু ছিল। ফলে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ চালু ছিল। এই কারণে রিজার্ভ তখন বেড়েছে।
কোভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে শুরু করলে সব কিছু কেনার প্রবণতা বাড়ে। তখন রিজার্ভ খরচ হওয়া শুরু হয়। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সাপ্লাই-চেইন ব্যাহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বেশি দামে পণ্য কেনার কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে।
তিনি বলেন, নরমাল সময়ে যে ফার্টিলাইজার ২০০ থেকে ২৫০ ডলার, সেটিই আমরা কিনলাম হচ্ছে ১০৫০ ডলার দিয়ে। রিজার্ভের রিকোয়ারমেন্ট তখন বাড়লো। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতির কারণে সুদের হার বেড়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর কারণেও দেশে রিজার্ভে টান পড়েছে।
মেজবাউল হক বলেন, ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের পার্থক্য হয়। যে কারণে ব্যাংকগুলো স্বল্প মেয়াদে যে ঋণ নিয়েছিল লোকসান কমাতে সেগুলো দ্রুত শোধ করার চেষ্টা করেছে। ফলে একদিকে রিজার্ভের ওপর যেমন টান পড়েছে, অন্যদিকে আবার লায়াবিলিটি পেমেন্ট বা ঋণের পরিমাণ কমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, লায়াবিলিটি পেমেন্ট কমতে কমতে সেপ্টেম্বরে আমাদের ৫০ মিলিয়নে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের পজিটিভ জিনিস চিন্তা করছি।
পতন ঠেকানোর উপায়
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে আমদানি ব্যয় ও ঋণ পরিশোধের জন্য যে পরিমাণ ডলার ব্যয় হয়, সেটার তুলনায় যদি জোগান না বাড়ে, তাহলে রিজার্ভের ওপর টান থাকবে। একে সামাল দেয়ার দুটি বিকল্প আছে। একটা হচ্ছে, চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতাকে সামাল দেয়ার জন্য ডলারের বিনিময় হার ছেড়ে দেয়া। অর্থাৎ যে পর্যায়ে উঠলে চাহিদা কমবে, সেটিকে সেই স্তরে উঠতে দিতে হবে।
তিনি বলেন, এতে ডলারের দাম বেড়ে গেলে কেনার প্রবণতা কমবে। আর আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বেশি দাম মেলায় প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়বে। সবমিলিয়ে চাহিদা কমে জোগান বাড়বে। এটাই ডলার সংকট সামাল দেয়ার সবচেয়ে টেকসই উপায়। দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে, ডলারের জোগান বিভিন্ন উৎস থেকে বাড়ানো, যা বাংলাদেশ বর্তমানে চেষ্টা করছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে চিন্তা করতে হবে যে কীভাবে তহবিলের ‘হার্ড ফ্লো’ বাড়িয়ে ভারসাম্য আনা যায়। সরকার এখন স্বল্প মেয়াদে নানা ডিল বা চুক্তি করছে। যেটি পরিশোধ করতে গেলে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে যাচ্ছে। এখান থেকে বের হতে হলে ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, বাজেটেও কিছু সংকোচনমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ২৩ অর্থবছরে সরকার টাকা ছাপানোর যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, সেটি থেকে সরে আসতে হবে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে এই চাপ আবার আসবে। তখন এটি ধরে রাখা গেলে সেটি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নির্বাচনের পর পরিবর্তন
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন- চলতি হিসাব এখন অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় চলে এসেছে। বছরখানেক আগেও এই হিসাব ঋণাত্মক ছিল। আমদানি কমিয়ে আনার মাধ্যমে চলতি হিসাবে ভারসাম্য ফেরানো হয়েছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক।
তিনি বলেন, এছাড়া সুদের হার আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ এবং ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশের জায়গা থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার বাড়ানোর নতুন নির্দেশনা দিয়েছে। এই অনুযায়ী, ঋণের সুদের হার এখন সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ হতে পারে। সুদ-হার বাড়ানোর পর হয়তো ডলারের মজুতে একটা ভারসাম্য আসতে পারে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হলে সেখানে ৬৭০ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলার নগদ সহায়তা ছাড় করানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ সেটা পাওয়ার আশা রয়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) থেকেও একই ধরনের অর্থায়নের জোগানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এছাড়া ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক(আইডিবি) এবং বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় সূত্র। যেমন-সৌদি আরবের কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলারের মতো সহায়তা, জাপান, জাইকার মতো উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের ৯ বিলিয়ন ডলার আসেনি। সেটার সিংহভাগ এই অর্থবছরে নির্বাচন সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা শেষ হয়ে গেলে এবং জানুয়ারির পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে ফেরত আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব অর্থ পাওয়া গেলে দেশের অর্থনীতিতে ৮ থেকে ৯ মাসের মতো একটা সময় পাওয়া যাবে। একইসঙ্গে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপের মতো বড় অর্থনীতিতে সুদের হার ও মুদ্রাস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। সুদের হার কমলে দেশের বহির্বাণিজ্যে আর্থিক খাতে যে বড় ঘাটতি আছে, সেটা পাল্টে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকের একটা পূর্বাভাস আছে যে, মার্চের মধ্যে তাদের মুদ্রাস্ফীতির হার ২ শতাংশের মধ্যে চলে আসবে। ইতোমধ্যে যা ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে। তারা মনে করছে, খুব দ্রুত এই হার আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই। এটি আরও কমে আসবে।
তিনি বলেন, এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজার আবার সক্রিয় হবে। বাংলাদেশ এখন যে সুদের হার বাড়িয়েছে, সেটি কার্যকর হবে। সেসময় ডলার প্রবাহও স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে আগামী বছরের জুন নাগাদ সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অবলম্বনে তৈরি