
ছবি সংগৃহীত
''চাঁদমামা'' যেমন রুপকথার বিরাট অংশ তার দখলে রেখেছেন স্নিগ্ধ আর মায়াবী সৌন্দর্য দিয়ে। ঠিক তেমনি অভিনয় শিল্পের মুকুট মাথায় নিয়ে, একজন হুমায়ুন ফরীদি বসন্তের পর বসন্ত পার করে যাচ্ছেন কিংবদন্তির আসনে।
একজন হুমায়ুন ফরীদি বারবার জন্মায় না। কিংবদন্তিদের জন্ম হয় শিল্পকে পথ দেখাতে। প্রকৃত অভিনেতা তিনিই যিনি মঞ্চ , নাটক, সিনেমা- সব জায়গাতেই দক্ষতার সাথে অভিনয় করে মানুষের মনে ভাবনার ফুল ফোঁটাতে পারেন।
১৯৫২ সালের আজকের দিনেই ঢাকায় এই কিংবদন্তির জন্ম হয়েছিল। । দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন ২য়। ১৯৭০ সালে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়ন বিভাগে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্থগিত হয়ে যায় তাঁর পড়াশোনা। স্বাধীনতার পর অর্থনীতি বিষয়ে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৭৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নাট্যোৎসব আয়োজনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতেই ফরীদি সম্পৃক্ত হন ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে। বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সদস্য হিসেবেও অভিনয়ের আলো ছড়িয়ে বেড়ান সারা দেশে। যদিও এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তনাট্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। এখানে তিনি ‘আত্মস্থ ও হিরণ্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লেখেন, নির্দেশনা দেন এবং অভিনয় করেন। এই নাটক ৫টি নাটকের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয় বিচারকদের কাছে। এ নাটকের সুবাদে পরিচয় ঘটে ঢাকা থিয়েটারের নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গে। মূলত এখান থেকেই হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়যাত্রা। ঢাকা থিয়েটারের মধ্য দিয়ে হুমায়ুন ফরীদির মঞ্চযাত্রা শুরু হয়।
তাঁকে স্মরণ করে এক স্মৃতিচারণায় নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেছিলেন, হুমায়ুন ফরীদি যখন প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করল, তখনই আমি সবাইকে বলেছিলাম, এই ছেলে মঞ্চ কাঁপাবে। অবশ্য ফরীদি কিন্তু মঞ্চের চেয়েও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চলচ্চিত্রে। তাঁর রসবোধ ছিল প্রখর। কোনো একটা সিরিয়াস মুহূর্তকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দিতে তার তুলনা ছিল না।
মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন ফরীদি। শকুন্তলার পর ‘ফণীমনসা’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ এবং ১৯৯০ সালে ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় হুমায়ুন ফরীদির ঢাকা থিয়েটার জীবন। মূলত বন্ধু-অভিনেতা আফজাল হোসেনের সাহস ও উৎসাহে হুমায়ুন ফরীদির টেলিভিশনযাত্রা শুরু হয়। আফজাল হোসেন বন্ধুর কথা ভেবে অনেকগুলো নাটক লেখেন। ১৯৮০ সালে ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এর মাধ্যমে টেলিভিশন নাটকে অভিষেক হয় হুমায়ুন ফরীদির। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘নীল নকশার সন্ধ্যায়’ ও ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ নাটকে অভিনয় করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন।
ফরীদি অভিনীত নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘সংশপ্তক’ (১৯৮৭-৮৮) ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ (১৯৮২),‘নীল নকশার সন্ধানে’ (১৯৮২), ‘বকুলপুর কতদূর’ (১৯৮৫)’, ‘একদিন হঠাৎ’ (১৯৮৬), ‘ও যাত্রা’ (১৯৮৬) ‘মহুয়ার মন’ (১৯৮৬), ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’ (১৯৮৬) ‘পাথর সময়’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’ (১৯৯৩), ‘চন্দ্রগ্রন্থ’ (২০০৬), ‘কাছের মানুষ’ (২০০৬), ‘কোথাও কেউ নাই’ (১৯৯০), ‘মোহনা’ (২০০৬), ‘ভবেরহাট’ (২০০৭), ‘জহুরা’,‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘শৃঙ্খল’ (২০১০), ‘প্রিয়জন নিবাস’ (২০১১), ‘অক্টোপাস’, ‘আরমান ভাই দি জেন্টেলম্যান’ (২০১১)-আরো আরো অনেক নাটকে বিরামহীনভাবে দর্শকদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘নীল নকশার সন্ধানে’ (১৯৮২), ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ (১৯৮২), ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ (১৯৮৩), ‘ভবের হাট’ (২০০৭), ‘শৃঙ্খল’ (২০১০) ইত্যাদি।
নব্বই দশকে এসে নাম লিখিয়েছিলেন ‘বানিজ্যিক ধারার বাংলা ছবিতে। ‘হুলিয়া’ দিয়ে প্রথম সিনেমাতে অভিনয়। ফরিদী অভিনয়ে এতোটাই অনবদ্য ছিলেন যে একসময় নায়কের চেয়ে বাংলা সিনেমা প্রেমী জাতির কাছে ভিলেন হুমায়ূন ফরিদী বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন। হলে তাঁর সিনেমা মুক্তি মানেই ওপচে পরা ভীড়! সেলুলয়েড়ের বিশাল পর্দায় ফরিদীর উপস্থিতি মানে দর্শকদের মুহুর্মুহু তালি। একটু একটু করে বাংলা সিনেমায় ভিলেনের সংজ্ঞাটাও যেন পরিবর্তন হতে থাকে।
দহন, আনন্দ অশ্রু, বিচার হবে, মায়ের অধিকার, একাত্তরের যীশু, ভন্ড, পালাবি কোথায়, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, হিংসা, বিশ্ব প্রেমিক, অপহরণের মতো জনপ্রিয় এবং একই সাথে বানিজ্যিকভাবে সফল ২৫০ টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত অন্যান্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘কন্যাদান’ (১৯৯৫), ‘আঞ্জুমান’ (১৯৯৫), ‘দুর্জয়’ (১৯৯৬), ‘শুধু তুমি’ (১৯৯৭), ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’. ‘বিদ্রোহ চারিদিকে, ‘ব্যাচেলর’ (২০০৪), ‘রূপকথার গল্প’ (২০০৬), ‘আহা!’ (২০০৭), ‘প্রিয়তমেষু’ (২০০৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ছবিতে অভিনয় করে এ দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনেন তিনি।
২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ফরীদি। ২০১৮ সালে পেয়েছেন মরণোত্তর একুশে পদক।
পৃথিবীর এতো রূপ বদলের ঘাটে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে..."সাদাকালোর ফ্রেম থেকে- ধ্যানে মনে; এখনো যাদু দেখান কী করে!"
আলোআভা/ শেখ ফরিদ