শুক্রবার ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ২২ ১৪৩১

Aloava News24 | আলোআভা নিউজ ২৪

হকার মরে ক্ষুধার জালায়, রাষ্ট্র তখন উচ্ছেদ চালায়

মাহফুজুল আলম খোকন, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রকাশিত: ১৬:৩৪, ২৪ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ১৩:৫৩, ২৬ অক্টোবর ২০২২

হকার মরে ক্ষুধার জালায়, রাষ্ট্র তখন উচ্ছেদ চালায়

মাহফুজুল আলম খোকন

রাজধানী ঢাকার অন্যতম মডেলটাউন বৃহত্তর উত্তরা এলাকায় ফুটপাত ও বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন যাবত ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সংসার চালানো প্রায় ১০ হাজার হকার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মারাত্মক আর্থিক সংকটে চিন্তায় পরেছেন তাদের পরিবার। হঠাৎ এত মানুষ কর্মহীন হওয়ায় সমাজিক অপরাধ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

টাকাও নিলো, আবার দৌড়ানিও দিলো, এমনেই চলতাছে আমাগর জীবন। এগুলান কইয়া লাভ নাই ভাই। ব্যবসা করতে না পারলে বৌ বাচ্চা লইয়া হয় না খাইয়া মরতে অইবো, নাইলে চুরি ডাকাতি করতে অইবো। লাইন খরচ তো আর কম দেইনা,তবুও জালায়। কাঁচা মাল বেচতে না পারলে সব নষ্ট হইয়া আমার চালান ধরা। কিস্তি দিমু কেমনে? এভাবেই বলছিলেন উত্তরা ৩নং সেক্টরে ভ্যান গাড়িতে করে সিজোনাল ফল বিক্রেতা নুরুল আলম। এমন ঘটনা এখন উত্তরায় নিত্য দিনের রুটিনে পরিনত হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য একটি সুত্রের তথ্য মতে হযরত শাহজালাল (রঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রেল ও বাসষ্ট্যান্ড থেকে তুরাগের ধউর বেড়িবাঁধ পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা ভ্রাম্যমান হকার রয়েছেন। আর এসকল দোকানের ওপর জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষ। এই আয়ে কোন মতে খেয়ে বেঁচে আছে কম-বেশী ৫০ হাজার মানুষ।

এসব দোকানের মধ্যে রয়েছে, গলায় ঝুলিয়ে বিক্রি করা পান সিগারেটের দোকান, হাতে ফ্লাক্স ঝুলিয়ে ও রাস্তার পাশের ফুটপাতে যেখানে মানুষের চলাচল কম এমন জায়গায় চা ষ্টল ও বিভিন্ন ধরনের ভাজাপোড়া, পুরি সিঙ্গারার দোকান। কোথাও বা কার্টনে কমদামি জামা কাপড়। আবার কোথাও নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য সল্প মুল্যের ভর্তা ভাত। কিছু স্থানে অল্প দামের বাহারি জামা কাপড় ও জুতার পশরা সাজানো রয়েছে তিন চাকার ভ্যানগাড়ির সারিতে। এছাড়াও দেশী বিদেশী বাহারি ফলমুল ও দৈনন্দিন শাক-সবজিও বিক্রি করা হয় ফুটপাতে । এসব দোকানের বিক্রেতা ও খদ্দের এর সিংহভাগ জীবিকার তাগিদে মডেল টাউনে বসবাস করা নিন্ম ও নিম্মমাধ্যম আয়ের মানুষ। এই দোকান গুলোই এই শহরে বসবাসকরা নিন্মবিত্তের টিকে থাকার একটা শক্তিও বটে। এসব দোকানের বেশীরভাগ ক্রেতা নিন্মআয়ের মানুষ।

তথ্য রয়েছে এসব দোকান থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে দৈনিক চাঁদা দিতে হয় আশি থেকে ৭শ টাকা পর্যন্ত,যার গড় দাঁড়ায় প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। এই টাকার একটি অংশও জমা হয়না রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। আবার ফুটপাত নির্ভর এসব দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি সন্তানদের দেশের সনামধন্য প্রতিষ্ঠান

বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও স্কুলে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন অনেকে। বছরের পর বছর এই ক্ষুদ্র ব্যবসায় চলার কারনে এটির উপরেই সম্পুর্ণ নির্ভর এই পরিবার গুলো।

কথা হয় রবীন্দ্র সরণি সড়কে ভ্যান গাড়িতে করে স্বল্পমূল্যের কাপড় বিক্রেতা সিদ্দিকুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, পাকড় বিক্রি করেই আমার সংসার চলে। আমার একটা মেয়ে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে ফার্মাসিষ্ট বিভাগে পড়ে, ছেলেটা পরীক্ষা দিবে এইবছর। আইজ ২৫ দিন দোকানপাট বন্ধ থাকার কারনে করোনার চেয়ে ভয়ংকর অনটন দেখা দিছে সংসারে। মেয়েটার ভার্সিটিতে এক হাজার টাকা জমা দেওয়ার আইজ শেষ দিন জানানোর পরেও দিতে পারিনাই, কান্তেকান্তে মেয়েটা আমার ভার্সিটিতে গেছে বলার সময় কান্নায় চোখ ভিজে টলমল করছিলো সিদ্দিকুরের। এমনি বাস্তব গল্প এখন বৃহত্তর উত্তরা এলাকার ১০-১২ হাজার মানুষের দৈনন্দিনের।

ইতোপুর্বেও বেশ কয়েকবার যখন তখন পুলিশি ধরপাকড় বন্ধ ও পুর্নবাসন দাবিতে আন্দোলন করেছিলো। গত ২রা ডিসেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার নির্বিচারে আটক বন্ধ এবং পুনর্বাসনের দাবিতে বেলা ১১টায় আজমপুর রবীন্দ্র সরণি থেকে মিছিল নিয়ে তারা রাজলক্ষ্মী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক বন্ধ করে সমাবেশ করেন ৭ হাজার হকার। পরে ঢাকা ১৮ আসনের সাংসদ আলহাজ হাবিব হাসান সকল দাবিদাওয়া বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলে হকাররা বিক্ষোভ ছেড়ে বাড়ি ফিরেন। প্রতিশ্রুতির প্রায় ১ বছর গত হলেও হকার পুর্নবাসনের বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। এদিকে প্রায় ১মাস যাবত ফুটপাত বন্ধ রাখায় মারাত্মক আর্থিক সংকটে পরেছেন এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অন্যান্য এলাকায় বিকেল ৪টা থেকে নিয়ম মেনে হকারদের বসার একটা রুটিন বাস্তবায়ন করা হলেও উত্তরা এলাকায় তা হচ্ছেনা বলে দাবি হকারদের।

এই বিষয়ে ঢাকা ১৮ আসনের সাংসদ আলহাজ মোহাম্মদ হাবীব হাসান খোলা কাগজকে বলেন, যেহেতু তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে এখন এখানে আর বসার সুযোগ নেই। ১৫-১৮ নং সেক্টরে সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি সাপেক্ষে তারা বসতে পারে। রাস্তা বন্ধ করে মডেল টাউনে বসা যাবেনা বলে জানিয়েছেন তিনি।

পরে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তৌহিদুল হক এর সাথে। তিনি দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ফুটপাতের হকার বা ভ্রাম্যমান এসব ব্যবসায়ী রাস্তার পাশে বসার কারনে

সাময়িক সমস্যার পাশাপাশি বিশাল একটা কর্মসংস্হানের ব্যবস্থাও হয়েছে। এসকল হকারদের পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদ করার কারনে পারিবারিক কলহ থেকে সমাজিক অবক্ষয়সহ আত্ম হত্যার মত ঘটনাও ঘটতে পারে। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক একটা নিয়মনীতি মাধ্যমে সুশৃঙ্খল ভাবে এদের ব্যবসার সুযোগ দিলে এখানে যে পরিমান অনৈতিক লেনদেন হতো তা সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বিশাল ভুমিকা রাকতে পারে। এতে সামাজিক অপরাধ কমাসহ লাখলাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

এই বিষয়ে বাংলাদেশী সামাজিক কর্মী, নারীবাদী, এবং পরিবেশবাদী খুশী কবির খোলা কাগজকে বলেন, ছিন্নমুল হলেও এখান থেকেই বছরের পর বছর হাজার হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে তাদের পরিবার চালাচ্ছেন । তাদের পুর্নবাসন না করে উচ্ছেদ করাটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের উচিত বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যয় এখানেও একটা শৃঙ্খলার মাধ্যমে পুর্নবাসন করে কর্মসংস্হান তৈরি করা বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

লেখক: সাংবাদিক, দৈনিক খোলা কাগজ

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়