রাজপথের সাহসী নেতা ‘নাসিম’

রাজু আনোয়ার: বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আরও যাদের নাম লেখা রয়েছে তাদের অন্যতম শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্বে ছিলেন তিনি।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত জাতীয় চারনেতার একজন ছিলেন এম মনসুর আলী ।
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম।রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন মোহাম্মদ নাসিম।বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এই মানুষটি ছিলেন রাজনীতির মাঠের এক অকুতোভয় সৈনিক । আন্দোলন-সংগ্রামে সাহসী ও আপোষহীন নেতা । কারাগারে মনসুর আলীকে হত্যার পর আওয়ামী লীগে সক্রিয় হন নাসিম। তখন তাকে কারা বরণও করতে হয়েছিল।
মোহাম্মদ নাসিম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। কিশোর বয়স থেকেই তিনি রাজনীতিবিদ বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাকিস্তান শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে মাঠে ছিলেন। ১৯৬৭ সালে পাবনায় বিখ্যাত ভুট্টা আন্দোলনে বাবার সঙ্গেই কারাবরণ করেন তিনি। ফলে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র নাসিম বন্দী অবস্থায় পাবনা কারাগারে বসে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে আইএ পাস করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন নির্ভীক যোদ্ধা।বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী নাসিম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের পরে তিনি রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হয়ে যান।পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারের আমলে দেশের বাইরে অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদের সঙ্গে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে তাকে ।
ছাত্র জীবনের প্রথম দিকে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। পরে অল্প কিছু দিন ছাত্রলীগের রাজনীতিও করেন। ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পরে যুবলীগের রাজনীতি করলেও ১৯৮১ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মোহাম্মদ নাসিম। ওই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে তিনি দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে মোহাম্মদ নাসিমকে দলের একমাত্র সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর টানা তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন।
সিরাজগঞ্জ-১ অর্থাৎ কাজিপুর উপজেলা ও সিরাজগঞ্জ সদর থানার বহুলী, ছোনগাছা, বাগবাটি, রতনকান্দি ও মেছড়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসনের এমপি মোহাম্মদ নাসিম ।১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। ২০০৮ সালে মোহাম্মদ নাসিম মামলাবিষয়ক জটিলতায় নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় ছেলে তানভীর শাকিল জয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।২০১৪ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।২০১৮ সালেও তিনি সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৮৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নাসিম। তখন সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপের দায়িত্ব পান তিনি। ২০১৪-১৮ সরকারের মেয়াদে নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৯৬ সালের সরকারে তিনি স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।বর্তমানে তিনি ১৪ দলীয় মহাজোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন । রাজনীতির পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মোহাম্মদ নাসিম ঢাকাসহ নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।
আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে আজ শনিবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর শ্যামলী বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বষয় হয়েছিল ৭২ বছর। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া জানান, মোহাম্মদ নাসিমের মরদেহ আগামীকাল রবিবার রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন হবে। তার মেজ ছেলে তন্ময় মনসুর যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর দাফন সম্পন্ন হবে।
জানা গেছে, সীমিত পরিসরে কোথায় জানাজা করা যায় তা নিয়ে নেতারা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তবে রবিবার বনানীতে বাদ জোহর তার দাফন হবে। মরদেহ শনিবার ওই হাসপাতালেই রাখা হবে। মোহাম্মদ নাসিমের মেজ ছেলে তন্ময় মনসুর যুক্তরাষ্ট্র থাকেন। তিনি আজ শনিবার দেশের উদ্দেশে রওয়ানা দেবেন। রবিবার দেশে এসে পৌঁছাবেন তিনি ৷
মুক্তিযোদ্ধা ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর সংবাদে আওয়ামী লীগসহ সারা দেশের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে ৷ মৃত্যুর খবর শুনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মন্ত্রীরা হাসপাতালে ছুটে যান।
রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী আ.লীগের এই নেতাকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন সময় নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে । আলোচিত এক –এগারো সরকারের সময়েও কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে । আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর বাবার মতোই বঙ্গবন্ধু পরিবারের আস্থাভাজন ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম।
রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে মোহাম্মদ নাসিমকে অনেকবার কারাবন্দী হতে হয়েছে। প্রথম তাকে কারাগারে যেতে হয় ১৯৬৬ সালে, যখন তিনি এইচএসসি পড়ছিলেন। সেই সময় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ভুট্টা খাওয়ানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পিতা এম মনসুর আলীর সঙ্গে কারাগারে যেতে হয় মোহাম্মদ নাসিমকেও। একবছর পরে তিনি ছাড়া পান।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এর মাত্র আড়াই মাসের মাথায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। গ্রেপ্তার হন মোহাম্মদ নাসিম। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মোহাম্মদ নাসিম বিভিন্ন সরকারের সময় জেল, জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন প্রয়াত এ নেতা। অংশ নেন ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন বাংলাদেশেও সামরিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। মোহাম্মদ নাসিম ৮০ দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের এক পরিচিত মুখ, রাজপথের লড়াকু সৈনিক। তাঁর নেতৃত্বে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে অসংখ্য মিছিল-মিটিং হয়। আন্দোলন সংগঠিত করতে ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে নাসিম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে রাজপথে আন্দোলনে প্রথম সারির নেতা ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। পুলিশের নির্যাতন সত্ত্বেও রাজপথ ছেড়ে যাননি। ২০০৪ সালের ৩ মার্চ কর্মসূচি চলাকালে পুলিশি অত্যাচার থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগের নেত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে তিনিই পুলিশের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছিলেন। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কর্মসূচি চলাকালে মোহাম্মদ নাসিমের ধানমন্ডির বাসায় দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য রান্না করা হতো।
২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারবিরোধী আন্দোলনে তিনি বার বার রাজপথে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন।কিন্তু আওয়ামী লীগ ও জাতির জনকের রাজনীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন সবসময়ই আপোষহীন। রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার কারণে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন।
পিতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর মতোই সাহসী ও আপোষহীন ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম।বার বার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই নেতা মাঠের রাজনীতিতে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন । বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার কারণে কারাগারে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিতে হয়েছিল বাবা মনসুর আলীর। তেমনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার আস্থা ভাজন হিসেবে রাজনীতি করার কারণে ১/১১ সরকারের সময়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। সে সময়ে বড় ধরনের স্ট্রোক করেন মোহাম্মদ নাসিম।
মোহাম্মদ নাসিমের মায়ের নাম মোসাম্মৎ আমিনা খাতুন, যিনি আমেনা মনসুর হিসেবেই পরিচিত। পারিবারিক জীবনে নাসিম বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক । তার স্ত্রীর নাম লায়লা আরজুমান্দ।
রাজনৈতিক মাঠে সুবক্তা হিসাবে পরিচিত মোহাম্মদ নাসিম ভোটের রাজনীতিতেও সফল হিসেবে পরিচিত। মোহাম্মদ নাসিম বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত ও বলিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে মিশে আছে তার নাম।মাঠের তুখোর নেতা মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যু রাজনীতিতে একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি।
আলোআভানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/আরএ